আজ ৯ ডিসেম্বর। বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালের একই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। সে হিসেবে বেগম রোকেয়ার ১৪৪তম জন্মবার্ষিকী ও ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী ৯ ডিসেম্বর। মানবসভ্যতার ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি শতক উনিশ শতকে বেগম রোকেয়ার জন্ম। এই শতকে জাতিসত্তার বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনও হয়ে ওঠে শক্তিশালী।
অনেক ইতিহাসবিদ এই সময়কালকে নবজাগরণের যুগ বলেও অভিহিত করেছেন। এই যুগে এসেছেন অনেক মহিষী, যাঁরা মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা। নারীর জীবনের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল। বেগম রোকেয়া এই দশকে এনেছিলেন আলোর দ্যুতি। সেই আলোর রশ্মি শুধু নারীসমাজকে নয়, পুরো সমাজকে আলোকিত করছে শতাব্দীব্যাপী।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিল নারীসমাজ। কিন্তু নারীর জীবনের অধস্তনতার কারণগুলো যে সমাজের প্রচলিত বিধিব্যবস্থা, সেটা তিনি দেখিয়ে গেছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম, ভাবনায় ও বক্তব্যে। তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি কারণগুলোকে শুধু চিহ্নিতই করেননি, নারীর জীবনে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাঁর রচিত প্রবন্ধ সংকলন ‘মতিচূর’, উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’সহ বিভিন্ন লেখায় যেমন নারীর অধস্তনতার কারণ বর্ণনা করেছেন, তেমনি নারী যে নিজের শক্তি ধারণ করে সব কাজে পারঙ্গম হয়ে উঠতে পারে—সেই স্বপ্নও দেখিয়েছেন।
শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নারীসমাজকে সংগঠিত করেছেন। নারীশিক্ষার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ আজও সগৌরবে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যাপক বহুমুখী কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া পরিণত হয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানে, যে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। বর্তমান সময়েও নারীসমাজ এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
আজকের সময়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ সামাজিক উন্নয়নের অনেক সূচকে অগ্রগামী। বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে নারী আজ ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল হয়েছে, সেনাবাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় যোগ দিয়েছে। পর্বতের শিখরে বাংলাদেশের পতাকাকে উড্ডীয়মান করেছে। কিন্তু নারীর মর্যাদার প্রশ্নটি রয়েছে উপেক্ষিত।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে সিডওর দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ তুলবে না সরকার। সিডও দলিল নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য জাতিসংঘ প্রণীত একটি সনদ। ১৯৭৯ সালে প্রণীত এই সনদ ১৯৮১ সাল থেকে কার্যকর হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ কয়েকটি ধারা সংরক্ষণসহ এই সনদ স্বাক্ষর করে। এখন পর্যন্ত সিডও সনদের ২ নম্বর ও ১৬(১) ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি বাংলাদেশ সরকার। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে যে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য শরিক দেশগুলো সব ধরনের প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; যা কিনা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অথচ সেই ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হলো না। ১৬(১) ধারায় বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে নারীর সমানাধিকার ও দায়িত্বের ঘোষণা ব্যক্ত হয়েছে। ওই ধারা দুটিতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার না করায় পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নারীর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে বাল্যবিবাহ নিরোধে যে বিল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে তার মাধ্যমে কন্যাশিশুর শৈশবকে হরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণীত হয়। এই আইনকে যুগোপযোগী সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়ায় অগ্রগতি না হয়ে পিছু হটার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিশ্ব সংস্থা ১৮ বছরের নিচে মানবসন্তানকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কাজেই ১৮-এর নিচে বিয়ে হলে সেটা বাল্যবিবাহ হিসেবে পরিগণিত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ সহায়তার জন্য এই সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার কার পক্ষ নেবে—নিপীড়কের, না নিপীড়িতের? বিশেষ ব্যবস্থার নামে নিপীড়িত নারীকে আরো দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন এখন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘরে-বাইরে, স্কুলে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবহন কোথাও নারী নিরাপদ নয়। নির্যাতন মামলার ধীরগতি, মামলায় প্রভাবশালীদের দাপটের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারীর শাস্তি হচ্ছে না। আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্যাতনকারীরা দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নির্যাতিতরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিন যাপন করছে।
আইনের প্রয়োগ যথাযথ না হওয়ায় নারী নির্যাতন হ্রাস পাচ্ছে না, নির্মূল করার পথে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা মন্ত্রণালয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া, রাষ্ট্র-সমাজ ও পরিবারে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় নারী নির্যাতন হ্রাস পাচ্ছে না। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সব বৈষম্য দূর করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেগম রোকেয়ার একটি বক্তব্য বারবার মনে আসে। তিনি বলেছেন, ‘নারী যখনই মস্তক উত্তোলন করেছে তখনই ধর্মের দোহাই দিয়ে মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করার চেষ্টা হয়েছে। ’ আজকের সময়ে সেটা যে কত প্রাসঙ্গিক, তা নিশ্চয় ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে যখন নারীর অগ্রগতির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, সরকার নারীর উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তখন নানা অজুহাত তুলে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি গোষ্ঠী সমাজকে পেছনে টেনে রাখার চেষ্টা করছে। আমরাও তাদের ভয়ে ভীত হচ্ছি।
নারীর সমমর্যাদা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে চিরাচরিত প্রথায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজের মানস গঠনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। ভারসাম্য তৈরি করার নামে পশ্চাদপসরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ। বেগম রোকেয়া ‘মতিচূর’ প্রবন্ধ সংকলন ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমাদের উচিত যে স্বহস্তে উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করা। ’ এই প্রবন্ধে তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রথমে জাগিয়া ওঠা সহজ নহে জানি, সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে। ’
আজ একবিংশ শতাব্দীতে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনায় যে মহাগোলযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনের জন্য রোকয়ার ভাষায় জবাব দিতে হবে।
‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদের যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। ’ তাই শুধু নারী নয়, দেশের একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বেগম রোকেয়া। আজ আমরা নারী আন্দোলনের সংগঠকরা যেমন ভাবি নারী আন্দোলন একটি সর্বব্যাপী আন্দোলন (Holistic), বেগম রোকেয়া আজ থেকে এক শতাব্দী আগে একটি সর্বব্যাপী চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন তাঁর সাহিত্য ও কর্মে। আজও তিনি সমাজ পরিবর্তনের আলোর দ্যুতি।বেগম রোকেয়া দিবস আজ
আজ ৯ ডিসেম্বর। বেগম রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালের একই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। সে হিসেবে বেগম রোকেয়ার ১৩৭তম জন্মদিন ও ৮৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ৯ ডিসেম্বর। মানবসভ্যতার ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি শতক উনিশ শতকে বেগম রোকেয়ার জন্ম। এই শতকে জাতিসত্তার বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনও হয়ে ওঠে শক্তিশালী।
অনেক ইতিহাসবিদ এই সময়কালকে নবজাগরণের যুগ বলেও অভিহিত করেছেন। এই যুগে এসেছেন অনেক মহিষী, যাঁরা মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে যুক্ত করেছেন নতুন মাত্রা। নারীর জীবনের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল। বেগম রোকেয়া এই দশকে এনেছিলেন আলোর দ্যুতি। সেই আলোর রশ্মি শুধু নারীসমাজকে নয়, পুরো সমাজকে আলোকিত করছে শতাব্দীব্যাপী।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিল নারীসমাজ। কিন্তু নারীর জীবনের অধস্তনতার কারণগুলো যে সমাজের প্রচলিত বিধিব্যবস্থা, সেটা তিনি দেখিয়ে গেছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম, ভাবনায় ও বক্তব্যে। তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি কারণগুলোকে শুধু চিহ্নিতই করেননি, নারীর জীবনে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাঁর রচিত প্রবন্ধ সংকলন ‘মতিচূর’, উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’সহ বিভিন্ন লেখায় যেমন নারীর অধস্তনতার কারণ বর্ণনা করেছেন, তেমনি নারী যে নিজের শক্তি ধারণ করে সব কাজে পারঙ্গম হয়ে উঠতে পারে—সেই স্বপ্নও দেখিয়েছেন।
শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নারীসমাজকে সংগঠিত করেছেন। নারীশিক্ষার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ আজও সগৌরবে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যাপক বহুমুখী কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া পরিণত হয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানে, যে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। বর্তমান সময়েও নারীসমাজ এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
আজকের সময়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ সামাজিক উন্নয়নের অনেক সূচকে অগ্রগামী। বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে নারী আজ ম্যাজিস্ট্রেট, উকিল হয়েছে, সেনাবাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় যোগ দিয়েছে। পর্বতের শিখরে বাংলাদেশের পতাকাকে উড্ডীয়মান করেছে। কিন্তু নারীর মর্যাদার প্রশ্নটি রয়েছে উপেক্ষিত।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে সিডওর দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ তুলবে না সরকার। সিডও দলিল নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য জাতিসংঘ প্রণীত একটি সনদ। ১৯৭৯ সালে প্রণীত এই সনদ ১৯৮১ সাল থেকে কার্যকর হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ কয়েকটি ধারা সংরক্ষণসহ এই সনদ স্বাক্ষর করে। এখন পর্যন্ত সিডও সনদের ২ নম্বর ও ১৬(১) ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি বাংলাদেশ সরকার। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে যে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য শরিক দেশগুলো সব ধরনের প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে; যা কিনা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অথচ সেই ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা হলো না। ১৬(১) ধারায় বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে নারীর সমানাধিকার ও দায়িত্বের ঘোষণা ব্যক্ত হয়েছে। ওই ধারা দুটিতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার না করায় পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও নারীর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে বাল্যবিবাহ নিরোধে যে বিল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে তার মাধ্যমে কন্যাশিশুর শৈশবকে হরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণীত হয়। এই আইনকে যুগোপযোগী সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়ায় অগ্রগতি না হয়ে পিছু হটার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিশ্ব সংস্থা ১৮ বছরের নিচে মানবসন্তানকে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কাজেই ১৮-এর নিচে বিয়ে হলে সেটা বাল্যবিবাহ হিসেবে পরিগণিত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ সহায়তার জন্য এই সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার কার পক্ষ নেবে—নিপীড়কের, না নিপীড়িতের? বিশেষ ব্যবস্থার নামে নিপীড়িত নারীকে আরো দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন এখন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘরে-বাইরে, স্কুলে-বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবহন কোথাও নারী নিরাপদ নয়। নির্যাতন মামলার ধীরগতি, মামলায় প্রভাবশালীদের দাপটের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারীর শাস্তি হচ্ছে না। আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্যাতনকারীরা দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নির্যাতিতরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিন যাপন করছে।
আইনের প্রয়োগ যথাযথ না হওয়ায় নারী নির্যাতন হ্রাস পাচ্ছে না, নির্মূল করার পথে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা মন্ত্রণালয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া, রাষ্ট্র-সমাজ ও পরিবারে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় নারী নির্যাতন হ্রাস পাচ্ছে না। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের সব বৈষম্য দূর করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেগম রোকেয়ার একটি বক্তব্য বারবার মনে আসে। তিনি বলেছেন, ‘নারী যখনই মস্তক উত্তোলন করেছে তখনই ধর্মের দোহাই দিয়ে মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করার চেষ্টা হয়েছে। ’ আজকের সময়ে সেটা যে কত প্রাসঙ্গিক, তা নিশ্চয় ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে যখন নারীর অগ্রগতির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, সরকার নারীর উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তখন নানা অজুহাত তুলে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি গোষ্ঠী সমাজকে পেছনে টেনে রাখার চেষ্টা করছে। আমরাও তাদের ভয়ে ভীত হচ্ছি।
নারীর সমমর্যাদা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে চিরাচরিত প্রথায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজের মানস গঠনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। ভারসাম্য তৈরি করার নামে পশ্চাদপসরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ। বেগম রোকেয়া ‘মতিচূর’ প্রবন্ধ সংকলন ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমাদের উচিত যে স্বহস্তে উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করা। ’ এই প্রবন্ধে তিনি আরো বলেছেন, ‘প্রথমে জাগিয়া ওঠা সহজ নহে জানি, সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে। ’
আজ একবিংশ শতাব্দীতে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনায় যে মহাগোলযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনের জন্য রোকয়ার ভাষায় জবাব দিতে হবে।
‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদের যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। ’ তাই শুধু নারী নয়, দেশের একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বেগম রোকেয়া। আজ আমরা নারী আন্দোলনের সংগঠকরা যেমন ভাবি নারী আন্দোলন একটি সর্বব্যাপী আন্দোলন (Holistic), বেগম রোকেয়া আজ থেকে এক শতাব্দী আগে একটি সর্বব্যাপী চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন তাঁর সাহিত্য ও কর্মে। আজও তিনি সমাজ পরিবর্তনের আলোর দ্যুতি।
দৈ. বার্তা সরণি/ এসস