অবশেষে নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার ২ মাস পর বিদ্যমান আইনে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইসি গঠনের সার্চ কমিটি গঠন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। আজ কালের মধ্যে সার্চ কমিটির গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। বিচারপতি জোবায়ের রহমানকে সার্চ কমিটির গঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
আইন অনুযায়ি সার্চ কমিট বিভিন্ন সংগঠনের কাছে নামের তালিকা জমা দেয়ার জন্য আহ্বান জানাবেন এরপর তালিকা থেকে বাছাই করে কমিশনের প্রতি পদের বিপরীতে ২ জনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে বাছাই করে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার কমিশনার নিয়োগ দেবেন। আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি হবে। জানা গেছে সার্চ নভেম্বর মাসের মধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরদিনই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি পদত্যাগের ঘোষণা দিল। এরপর থেকে নির্বাচন ইসি পদশূণ্য রয়েছে। তবে এই মুহুর্তে দেশে কোন নির্বাচন না থাকায় কোন সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়নি। সরকার গঠনের ২ মাস পর এবার নতুন করে ইসি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রথম বারের মতো আইন প্রণয়ন করে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। ওই আইনের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে দেন রাষ্ট্রপতি। ঐ কমিটির সুপারিশে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের ইসি গঠন করা হয়, যাদের নেতৃত্বে সর্বশেষ বিতর্কিত ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুতির পর কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করে।
তৎকালীন সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এত দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হলো।
আইনের ১ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ নামে অভিহিত হবে এবং যা অবিলম্বে কার্যকর হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক। সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। এ দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন হবেন নারী। তিন সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির সভার কোরাম হবে। এ কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সার্চ কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হবে।
সার্চ কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি: আইনের ৪ ধারায় কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিন্নতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। এজন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে তারা নাম আহ্বান করতে পারবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতির কাছে ২ (দুই) জন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে কমিটি।
সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা: আইনের ৫ ধারায় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদের জন্য কোনো ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৫০ বছর। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা-সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এদিকে ইসি গঠন বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে আজ-কালের মধ্যে সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে ভোটার তালিকা নিয়ে কাজ করা হবে।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান উপদেষ্টা। উপদেষ্টা বলেন, কারণ নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য যে সার্চ কমিটি, সেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। আমি যতদূর জানি, সেই প্রজ্ঞাপনটা আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বাক্ষর করে দিলেই আপনারা জানতে পারবেন। হয়তো উনি করেছেনও আজ-কালের মধ্যে জেনে যাবেন।
আসিফ নজরুল বলেন, সার্চ কমিটি হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে ভোটার তালিকা...আগেও বলেছি, ভোটার তালিকা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন ছিল, গত নির্বাচন এমন ভুয়া নির্বাচন ছিল, ভোটার তালিকা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা ছিল না। তিনি বলেন, এবার অসাধারণ একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবো। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, ভলকার তুর্ককে বলেছি, আমাদের আইনগত যে সংস্কার, সেটাতে তারা জড়িত আছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে আমাদের যদি ফরেনসিক সহায়তা প্রয়োজন হয়, সেটা তারা দেবেন। আমরা এখানে সুবিচার করবো, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিচার করছি না। আগের আদালতে যেভাবে হয়েছে, সেভাবে আমরা অবিচার করবো না। আমাদের কোনোকিছু লুকানোর নেই।
দৈ. বার্তা সরণি / একে